আন্তর্জাতিক আইন
বর্তমান পারস্পরিক সৌহার্দ এবং শান্তিপূর্ণ সহ অবস্থানের যুগে কোন রাষ্ট্রের পক্ষেই বিচ্ছিন্ন ও নিঃসঙ্গভাবে টিকে থাকা সম্ভব নয়। বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্র এখন বিভিন্ন ক্ষেত্রে এবং বিভিন্নভাবে নির্ভরশীল ও সম্পর্কযুক্ত। বিভিন্ন রাষ্ট্রের এ নির্ভরশীলতা ও পরস্পর সম্পর্ক যে আইনের মাধ্যমে পরিচালিত হয়ে থাকে তাকেই বলা হয় আন্তর্জাতিক আইন।
আন্তর্জাতিক আইনের সংজ্ঞা
বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্র যে সব বিধি-বিধানের মাধ্যমে তাদের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক বজায় রাখে সেগুলো হচ্ছে আন্তর্জাতিক আইন। এসব আইনের মাধ্যমে রাষ্ট্রগুলোর পারস্পরিক সম্পর্ক পরিচালিত ও নিয়ন্ত্রিত হয়ে থাকে। টি.জে লরেন্স (T. J. Lawrence)-এর মতে, "আন্তর্জাতিক আইন হচ্ছে সেসকল বিধান যেগুলো সভ্য রাষ্ট্রগুলোর কর্মকাণ্ডের মধ্যে পারস্পরিক লেনদেন নির্ধারণ করে।"
ওপেনহ্যাইম (Oppenheim) আন্তর্জাতিক আইনকে সংজ্ঞায়িত করতে গিয়ে লিখেছেন "যেসব চিরাচরিত সামাজিক বিধানকে সভ্য রাষ্ট্রগুলো তাদের নিজেদের মধ্যকার সম্পর্ক বজায় রাখার ব্যাপারে বৈধভাবে অবশ্য পালনীয় বলে মনে করে সেগুলোকে আন্তর্জাতিক আইন বলে অভিহিত করা হয়।" অধ্যাপক হুইটন (Wheaton) -এর মতে, "স্বাধীন রাষ্ট্রগুলোর সমাজ ব্যবস্থার প্রকৃতি এবং উক্ত সমাজ যেসব যুক্তিবোধসজ্ঞাত ধারণা তথা ন্যায়বিচারের ধারণা থেকে উদ্ভুত সেগুলো পরিচালনার জন্য নির্ধারিত বিধিবিধানের সমষ্টি হচ্ছে 'আন্তর্জাতিক আইন'। আবার জোসেফ ফ্রাংকেলের (Joseph Frankel) কথায় বলতে গেলে বলতে হয় যে, "আন্তর্জাতিক আইন রাষ্ট্রগুলোর উপর নয় বরং রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে কার্যকরী আইন" ("International law is not a law above states but one between them.")
বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্রের মধ্যকার পারস্পরিক সম্পর্ক নির্ধারণকারী আইনকে বলা হয় আন্তর্জাতিক আইন। অর্থাৎ আন্তর্জাতিক আইন আন্তঃরাষ্ট্রীয় সম্পর্ক নিয়ন্ত্রণকারী আইন। গ্রোসিয়াস (Grotius)-এর মতে, "আন্তর্জাতিক আইন সে সব প্রথা ও সন্ধির শর্তাবলী নির্দেশ করে যেগুলো বিভিন্ন রাষ্ট্রের পারস্পরিক ক্রিয়াকলাপে আইনগতভাবে কার্যকরী বলে বিবেচিত হয়।" সকল আন্তর্জাতিক আইনই বিভিন্ন রাষ্ট্র কর্তৃক সর্বজনীনভাবে পালিত হয়ে থাকে।
আন্তর্জাতিক আইনের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য এই যে, এ আইন অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে তেমন কোন কার্যকর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা যায় না। এর প্রধান কারণ হলো রাষ্ট্রগুলো যথার্থভাবেই সার্বভৌম; কাজেই এদের উপর কোন ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ থাকতে পারে না যাকে আইন দ্বারা নিয়ন্ত্রণ করা যায়। কিন্তু যদি এমন কোন ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ থাকে তবে রাষ্ট্রগুলোর সার্বভৌমত্ব ক্ষুন্ন হয়। তবে বর্তমান বিশ্বে অর্থনৈতিক অবরোধের মাধ্যমে বিভিন্ন রকম নিয়ন্ত্রণ আনা সম্ভব হচ্ছে। এই অসঙ্গতি দূর করা সম্ভব একমাত্র সার্বভৌম রাষ্ট্রগুলো এবং আন্তর্জাতিক আইনের মধ্যে সামঞ্জস্য প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। বলা বাহুল্য, জাতিসংঘ কর্তৃক সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণার ফলে আন্তর্জাতিক আইন এখন উন্নততর হচ্ছে।
আন্তর্জাতিক আইনের উৎস
(Sources of International Law)
অতি সাম্প্রতিক কালে আন্তর্জাতিক আইনের উদ্ভব ঘটেছে। প্রকৃতপক্ষে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অগ্রগতি ও বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে আন্তর্জাতিক আইনেরও অগ্রগতি ও বিকাশ সাধিত হয়েছে। ইউরোপীয় সভ্যতা থেকে শুরু করে রোমান সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা এবং সংস্কার যুগ পেরিয়ে তা আধুনিককালে অনুপ্রবেশ করেছে। এ বিবর্তন ধারায় আন্তর্জাতিক আইন একাধিক উৎস থেকে বিকশিত হয। নিচে আন্তর্জাতিক আইনের কতিপয় উৎস সম্পর্কে আলোচনা করা হলো—
রোমান আইন: আন্তর্জাতিক আইনের একটি উৎস হলো রোমান আইন। দুটো প্রধান উপায়ে রোমান আইন আন্তর্জাতিক আইনের মূল ভিত্তি হিসেবে কাজ করেছে। প্রথমত, জাতিগুলোর আইনের ধ্যান-ধারণা দ্বারা এবং দ্বিতীয়ত, আইনের চোখে সকলে সমান এ ধারণার মাধ্যমে। আন্তর্জাতিক আইনের এ ধারণা সার্বভৌম রাষ্ট্রগুলো সমতা বর্ধন করতে বিশেষভাবে সহায়তা করেছে। রোমান আইন মূলত প্রাচীন রোম সাম্রাজ্যের আইন এবং এটি পাশ্চাত্য আইনের (Western Legal Tradition) ভিত্তি তৈরি করেছে। রোমান আইনের অনেক সাধারণ নীতিমালা, যেমন-Pacta Sunt Servanda (চুক্তি অবশ্যই পালনীয়), আন্তর্জাতিক আইনের ভিত্তি হিসেবে ব্যবহৃত হয়। রোমান আইন প্রাকৃতিক আইন (Natural Law) এবং ন্যায়বিচারের (Equity) ধারণার ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছিল। এই ধারণাগুলো আধুনিক আন্তর্জাতিক আইনের নীতিগত কাঠামোতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। উদাহরণস্বরূপ, ন্যায্যতা এবং সার্বভৌমত্বের স্বীকৃতি আন্তর্জাতিক বিরোধ নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ।
রোমান আইনে "Ius Gentium" নামে পরিচিত একটি ধারণা ছিল, যা বিভিন্ন জাতি ও জনগণের মধ্যে সম্পর্ক পরিচালনার জন্য প্রণীত আইন। এটি আধুনিক আন্তর্জাতিক আইনের ভিত্তিমূল হিসেবে ধরা হয়। Ius Gentium মূলত বিভিন্ন জাতির অভ্যাস ও প্রথার ওপর ভিত্তি করে তৈরি হয়েছিল এবং এটি রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে সাধারণ আচরণ নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা পালন করে।
সন্ধি ও চুক্তি: যে কোন উদ্দেশ্যে সাধিত চুক্তি ও সন্ধিগুলো, (বাণিজ্যিক বা রাজনৈতিক), আন্তর্জাতিক আইনের অপর একটি বিশেষ উৎস হিসেবে স্বীকৃত। এ ধরনের চুক্তি আন্তর্জাতিক আইনের বিকাশে প্রভৃত পরিমাণে সাহায্য করেছে। ভিয়েনা চুক্তি আইন সম্পর্কিত কনভেনশন (Vienna Convention on the Law of Treaties, 1969) অনুযায়ী সন্ধি বা চুক্তিকে আন্তর্জাতিক আইনের একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎস হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, ওয়েস্টফালিয়া শান্তিচুক্তি (১৬৪৮), প্যারিস চুক্তি (১৭৬৩ ও ১৮৬৪), ভার্সাই চুক্তি (১৯১৯) এসবের উল্লেখ করা যায়।
প্রথা ও রীতিনীতি
প্রথা ও রীতিনীতিগুলো আন্তর্জাতিক আইনের অপর এক বিশেষ উৎস বলে স্বীকৃতি লাভ করেছে। প্রকৃত প্রস্তাবে আন্তর্জাতিক আইন প্রথা ভিত্তিক। প্রাচীন ও মধ্যযুগের রাষ্ট্রগুলোর মধ্যকার লেনদেন ছিল মূলত প্রথা ও রীতিনীতির উপর ভিত্তিশীল। এসব প্রথা ও রীতিনিীতি পরবর্তীকালে আইনের মর্যাদা অর্জন করে। আন্তর্জাতিক প্রথা ও রীতিনীতি (Customary International Law) আন্তর্জাতিক আইনের অন্যতম প্রাচীন এবং গুরুত্বপূর্ণ উৎস। এটি দীর্ঘকাল ধরে রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে প্রচলিত অভ্যাস ও চর্চার মাধ্যমে গঠিত হয়, যা সময়ের সঙ্গে বাধ্যতামূলক আইনের মর্যাদা লাভ করে। যেমন State Practice হিসেবে ‘সমুদ্রসীমা নির্ধারণে ১২ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত রাষ্ট্রীয় সমুদ্রসীমা গ্রহণ’ এবং Opinio Juris হিসেবে’যুদ্ধের সময় বেসামরিকদের উপর হামলা না করার নীতি’
রাষ্ট্রীয় আইন(Domestic Law)
রাষ্ট্রীয় আইনের মধ্যে আন্তর্জাতিক আইনের বীজ নিহিত। প্রতিটি রাষ্ট্রের পৌর আইনের সংবিধি (Statutes) আন্তর্জাতিক আইনের অগ্রগতি ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক নির্ণয়ে সবিশেষ সহায়ক ভূমিকা পালন করে। নাগরিকতা, অভিবাসন আইন, নিরপেক্ষতা ইত্যাদি সংক্রান্ত আইন আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে যথেষ্ট ভূমিকা রাখে। মনিস্ট পদ্ধতিতে(Monist Approach) আন্তর্জাতিক আইন এবং রাষ্ট্রীয় আইন একে অপরের অংশ। আন্তর্জাতিক আইন রাষ্ট্রীয় আইনের উপরে প্রাধান্য পায়।উদাহরণ: নেদারল্যান্ডস বা ফ্রান্সের মতো দেশ।
প্রখ্যাত আইনজ্ঞদের বক্তব্য(Teachings of Publicists)
অনেক প্রখ্যাত আইন বিশারদ আন্তর্জাতিক আইন সম্পর্কে বক্তব্য তুলে ধরেছেন। তাঁদের এসব বক্তব্য আন্তর্জাতিক আইনের উৎস হিসেবে কাজ করে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সমস্যা ও মামলা নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে তাঁদের বক্তব্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এছাড়াও প্রখ্যাত আইনজ্ঞদের লিখিত গ্রন্থ যেমন হুগো গ্রসিয়াস (Hugo Grotius)-এর "On the Law of war and Peace" যা ১৬২৫ সালে প্রকাশিত হয় তা আন্তর্জাতিক আইনের তাত্ত্বিক ভিত্তি প্রদান করে। এছাড়াও রয়েছে পুফেনডরফ (Pufendorf) লিখিত "Law of Nature and Nations" এবং জায়েবনিজ (Zaibniz) বিরচিত Diplomatic Code of the Law of Nations" যা আন্তর্জাতিক আইনকে সুনির্দিষ্ট রূপ দিতে বিশেষভাবে সাহায্য করে। আন্তর্জাতিক বিচার আদালতের বিধিমালা (Article 38 of the ICJ Statute)-এ বলা হয়েছে যে, প্রখ্যাত আইনজ্ঞদের বক্তব্য আন্তর্জাতিক আইনের "সহায়ক উৎস" হিসেবে বিবেচিত হবে।
যুদ্ধ ও কূটনীতির ইতিহাস(History of War and Diplomacy)
যুদ্ধের ইতিহাস, বিভিন্ন চুক্তি ও সন্ধি স্থাপন ইত্যাদি আন্তর্জাতিক কর্মকাণ্ড আন্তর্জাতিক আইনের বিকাশ সাধনে উল্লেখযোগ্য সহায়তা করেছে। যুদ্ধকালীন সময়ে বিভিন্ন রাষ্ট্র কর্তৃক গুরুত্বপূর্ণ ঘোষণা আন্তর্জাতিক আইনের এক প্রধান উৎস হিসেবে স্বীকৃত হয়। উদাহরণস্বরূপ আটলান্টিক চার্টার (The Atlanic Charter), পটড্যাম চুক্তি (The Potsdam Agreement)-এর উল্লেখ করা যায়।
প্রাচীন সভ্যতাগুলোতে যুদ্ধ ও কূটনীতির মাধ্যমে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ভিত্তি গড়ে ওঠে। কাদেশ সন্ধি (Treaty of Kadesh) এটি প্রাচীন মিশর এবং হিট্টাইট সাম্রাজ্যের মধ্যে স্বাক্ষরিত এবং বিশ্বের প্রথম লিখিত শান্তি চুক্তি হিসেবে বিবেচিত। মধ্যযুগে ধর্ম, সাম্রাজ্যবাদ, এবং সামরিক শক্তি আন্তর্জাতিক সম্পর্ক নির্ধারণ করত। ১৫৫৫ সালের অগসবার্গ শান্তি (Peace of Augsburg): ধর্মীয় স্বাধীনতার প্রাথমিক নীতি গঠন করা হয়। তেমনি আধুনিক আন্তর্জাতিক আইনের ভিত্তি মূলত ১৬৪৮ সালের ওয়েস্টফালিয়ার শান্তি চুক্তি (Treaty of Westphalia) থেকে গড়ে ওঠে।
কূটনীতিবিদ ও রাষ্ট্রনায়কদের অভিমত
কূটনীতিবিদ ও রাষ্ট্রনায়কদের লিখিত মতামতও আন্তর্জাতিক আইনের এক গুরুত্বপূর্ণ উৎস হিসেবে কাজ করে। তাঁদের এসব মতামত সাধারণত স্টেট পেপার (State Paper) এবং বৈদেশিক অফিসে কূটনৈতিক পত্র লিখনের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে। এছাড়া রাষ্ট্রনায়কগণ তাঁদের বক্তৃতা-বিবৃতির মাধ্যমে গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক ও পররাষ্ট্র বিষয়াদির ক্ষেত্রে অমূল্য অভিমত ব্যক্ত করে থাকেন যা আন্তর্জাতিক আইন তৈরীর বেলায় পথ প্রদর্শক হিসেবে কাজ করে।
আন্তর্জাতিক চুক্তি প্রণয়ন ও স্বাক্ষরের সময় কূটনীতিবিদদের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাদের বক্তব্য ও অভিমত চুক্তির কাঠামো এবং ব্যাখ্যা গঠনে সাহায্য করে। ভার্সাই চুক্তি (1919)-তে রাষ্ট্রনায়কদের ভূমিকা ছিল। উইনস্টন চার্চিল, ফ্র্যাঙ্কলিন রুজভেল্ট এবং জোসেফ স্টালিন কর্তৃক গৃহীত নীতিগুলো জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে ভূমিকা রেখেছে। জাতিসংঘের পূর্বসূরি লীগ অব নেশনস (League of Nations) প্রতিষ্ঠার জন্য উড্রো উইলসন (Woodrow Wilson) এর Fourteen Points একটি গুরুত্বপূর্ণ দলিল ছিল।
অহিংস নীতির মাধ্যমে আন্তর্জাতিক শান্তি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে মহাত্মা গান্ধী’র মতামত পরোক্ষভাবে আন্তর্জাতিক আইনকে প্রভাবিত করেছে। জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব হিসেবে কফি আনানের বক্তব্য এবং নীতিমালা আন্তর্জাতিক আইনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে, বিশেষ করে মানবাধিকার এবং শান্তি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হেনরি কিসিঞ্জার (Henry Kissinger) শীতল যুদ্ধের সময় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন এবং বিভিন্ন আন্তর্জাতিক চুক্তির (যেমন ভিয়েতনাম যুদ্ধবিরতি) ভিত্তি স্থাপন করেন।
জাতিসংঘের সিদ্ধান্তসমূহ(Decisions of the United Nations)
আধুনিক বিশ্বে জাতিসংঘ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক বিষয়ে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। এসব সিদ্ধান্ত আন্তর্জাতিক আইনের স্বরূপ ও প্রকৃতি অনেকাংশে নির্ধারণ করে থাকে। জাতিসংঘ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সমস্যার সমাধানে পারস্পরিক আলাপ-আলোচনা, মধ্যস্থতা, সালিশী তৎপরতা এবং আন্তর্জাতিক আদালতদের রায় ও বিভিন্ন প্রস্তাব গ্রহণের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক আইনের গতি-প্রকৃতি নির্ধারণে সচেষ্ট হয়। জাতিসংঘের বিভিন্ন অঙ্গ, বিশেষত জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ, সাধারণ পরিষদ, এবং আন্তর্জাতিক বিচার আদালত (ICJ), বিভিন্ন সিদ্ধান্ত এবং প্রস্তাবনা গ্রহণ করে যা আন্তর্জাতিক আইনের বিকাশ এবং প্রয়োগে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ থেকে গৃহীত আইনগতভাবে বাধ্যতামূলক সিদ্ধান্ত (Legally Binding Decisions) বিশেষ করে Chapter VII of the UN Charter অনুসারে, সদস্য রাষ্ট্রগুলোর জন্য বাধ্যতামূলক। বলা যায় যে-ইরাকের বিরুদ্ধে ১৯৯১ সালের নিরাপত্তা পরিষদের নিষেধাজ্ঞা এবং লিবিয়ায় সামরিক হস্তক্ষেপের অনুমোদন (২০১১) মতো সিদ্ধান্ত।
তাছাড়া জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক বিচার আদালত (ICJ) বিভিন্ন মামলার মাধ্যমে আন্তর্জাতিক আইনের ব্যাখ্যা দেয় এবং বিচারিক নজির তৈরি করে। এক্ষেত্রে নিকারাগুয়া বনাম যুক্তরাষ্ট্র মামলা (1986) আন্তর্জাতিক আইনে বলপ্রয়োগের নীতি স্পষ্ট করার ইত্যাদি তুলে ধরা যায়।
উপরোক্ত আলোচনা থেকে আন্তর্জাতিক আইনের উৎস সম্পর্কে আমরা সম্যক ধারণা লাভ করতে সক্ষম হই। বস্তুত: এসব উৎস আন্তর্জাতিক আইনকে এক বিশেষ মর্যাদা দান করেছে।
আন্তর্জাতিক আইনের পরিধি বা বিষয়বস্তু
আন্তর্জাতিক আইনের পরিধি বা বিষয়বস্তুর ব্যাপ্তি লক্ষ্য করার মত। আন্তর্জাতিক আইনের পরিধি সকল স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্রের পারস্পরিক সম্পর্ক নির্ণয় করে। এ আইন অনুসারে ছোট বড় সকল রাষ্ট্রই সমান মর্যাদা ভোগ করে। এ সমতার কারণেই এক রাষ্ট্র অপর রাষ্ট্রের উপর কোন নিজস্ব আইন ন্যায়সঙ্গতভাবে চাপিয়ে দিতে পারে না।
আন্তর্জাতিক আইনের পরিধি বা বিষয়বস্তুকে নিম্নোক্ত কয়েকটি ভাগে ভাগ করা যায়–
ক) শান্তিকালীন সময়ে রাষ্ট্রগুলো কর্মকাণ্ড পরিচালনাকারী আইন
শান্তিকালীন সময়ে রাষ্ট্রগুলোর কর্মকাণ্ড পরিচালনাকারী আইনের মধ্যে বিভিন্ন রাষ্ট্রের স্বাধীনতার ক্ষেত্রে সমতার দায়িত্ব ও কর্তব্য, জাহাজ চলাচল সংক্রান্ত আইন, পররাষ্ট্র দপ্তরসমূহের কর্মকর্তাদের দায়িত্ব, কর্তব্য ও অধিকার, কূটনৈতিক প্রতিনিধিদের বিশেষ অধিকার ও সুযোগ-সুবিধা, আন্তর্জাতিক সম্মেলনগুলোর সংগঠন ও কার্যপ্রণালী, সন্ধিস্থাপন ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
খ) যুদ্ধ চলাকালে রাষ্ট্রগুলোর কর্মকাণ্ড পরিচালনাকারী আইন
যুদ্ধ চলাকালে যুদ্ধ আইন ও নীতিমালা প্রণয়ন আন্তর্জাতিক আইনের অন্তর্ভুক্ত। যুদ্ধ ঘোষণা করা, যুদ্ধের শ্রেণীবিভাগ, জল-স্থল ও অন্তরীক্ষে যুদ্ধের আইন ও রীতি-নীতি, যুদ্ধোত্তর কালে যুদ্ধের প্রভাব, যুদ্ধবন্দীদের সঙ্গে আচরণ, যুদ্ধে বিষজনিত কোন গ্যাস বা জীবাণু ব্যবহার নিষিদ্ধ করা এবং বেসামরিক এলাকায় বোমা হামলা বা নিক্ষেপ না করা আন্তর্জাতিক আইনের অন্তর্ভুক্ত বিষয়।
গ) নিরপেক্ষতার সম্পর্ক বজায় রাখার জন্য আইন
নিরপেক্ষতার সম্পর্ক বজায় রাখা সংক্রান্ত আইনের মধ্যে রয়েছে শত্রু আক্রান্ত রাষ্ট্রগুলোর প্রতি নিরপেক্ষ রাষ্ট্রগুলোর দায়-দায়িত্ব, নিরপেক্ষ ব্যবসা-বাণিজ্য, বাণিজ্যিক ও অন্যান্য অবরোধ আরোপ করা।
জাতিসংঘ সনদ(UN Charter_29_9_2021 Bangla) download করুন
0 Comments