ঢাকার সিএমএম কোর্ট বাংলাদেশের বৃহত্তম ক্রিমিনাল কোর্ট। এই কোর্টে প্রতিদিন শতশত বেইল পিটিশন(Bail Petition) শুনানি ও নিষ্পত্তি করা হয়। সিএমএম কোর্টে প্রধানত চারটি পদ্ধতিতে জামিন করা যায়। যেমন—
১। প্রোডাকশন কেইসে(Production Case) জামিন
২। সারেন্ডার কেইসে(Surrender Case) জামিন
৩। পুট আপ কেইসে(Put-up Case) জামিন
৪। স্পেশাল পুট আপ কেইসে (Special Put-up Case)জামিন
প্রোডাকশন কেইসে(Production Case) জামিন পদ্ধতি
প্রতিদিন থানা হতে যতগুলি আসামীকে ঢাকার সিএমএম কোর্টে পাঠানো হয় তাদেরকে কোর্ট হাজতখানায় রাখা হয়। কোর্ট হাজতখানাকে আদালত প্রাঙ্গণের চালু ভাষায় গারদখানাও বলে। কোর্ট হাজতে রাখার সময় আসামীদের দুইটি তালিকা প্রস্তুত করা হয়। একটি তালিকা হলো–জিআর কেইসের জন্য,(General Register Case হলো থানায় দায়ের হওয়া ফৌজদারি মামলার বিচারিক রেকর্ড) এবং অন্য আরেকটি তালিকা নন-জিআর কেইসের(CR-Complaint Register কেইস হিসেবে থানা থেকে শুরু হয়নি, বরং ভুক্তভোগী ব্যক্তি সরাসরি আদালতের কাছে আবেদন করে মামলা শুরু করেন ) জন্য প্রস্তুত করা হয়। জি আর কেইসের তালিকাকে ধর্তব্য মামলার তালিকা বলে। ইহাকে আদালত প্রাঙ্গণের চালু ভাষায় জিআর লিষ্টও বলে। নন-জিআর আসামীদের তালিকাকে অধর্তব্য মামলার তালিকা বলে। আদালতের ভাষায় এগুলোকে নন-জিআর লিষ্টও বলে। এই দুইটি লিষ্টের কেইস গুলোকে একত্রে ঐ দিনের প্রোডাকশন কেইস বলা হয়।
প্রোডাকশন কেইসে (Production Case) জামিন পদ্ধতি — বিস্তারিত ব্যাখ্যা
প্রোডাকশন কেইসে একজন আসামিকে যিনি ইতিমধ্যে অন্য কোনো মামলায় হাজতে আছেন, তাকে নতুন মামলায় আদালতে হাজির করার জন্য আনা হয়। এই প্রক্রিয়ায় যদি আসামি জামিন চাইতে চান, তাহলে আদালতের অনুমতির মাধ্যমে তিনি জামিন আবেদন করতে পারেন। যেমন ধরা যাক, একজন আসামি অস্ত্র মামলায় কারাগারে। হঠাৎ তার নামে একটি ডাকাতি মামলায় প্রোডাকশন ওয়ারেন্ট ইস্যু হলো। সে আদালতে হাজির হলো, এবং ওই মামলায় জামিন চাইলো। শুনানির পরে আদালত জামিন মঞ্জুর করল — এটি প্রোডাকশন কেইসে জামিনের বাস্তব চিত্র। তবে এ ক্ষেত্রে কিছু fact আছে। যেমন, Production-এর দিনে আদালতে আসামি হাজির হলে সংশ্লিষ্ট ম্যাজিস্ট্রেট বা দায়রা জজ কর্তৃক বন্ডে জামিন পাওয়া যাবে। কিন্তু জামিন না হলে আবার জেলে পাঠাবে।
Production Case-এ জামিন পদ্ধতির ধাপসমূহ:
ধাপ ১: আসামির প্রোডাকশন ওয়ারেন্ট ইস্যু
ক। তদন্ত কর্মকর্তা আদালতের কাছে আবেদন করে যে, আসামি অমুক বর্তমানে জেলহাজতে আছেন, তাকে নতুন মামলায় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য/আদালতে উপস্থাপনের প্রয়োজন।
খ। আদালত Production Warrant ইস্যু করে।
ধাপ ২: আসামিকে আদালতে আনা হয়
ক। জেল কর্তৃপক্ষ আদালতের নির্দেশে নির্ধারিত দিনে আসামিকে আদালতে উপস্থিত করে।
ধাপ ৩: জামিনের আবেদন দাখিল
ক। আসামি বা তার আইনজীবী আদালতের কাছে জামিনের আবেদন দাখিল করেন।
খ। এটি সাধারণত একটি লিখিত পিটিশন আকারে দাখিল করা হয়।
ধাপ ৪: রাষ্ট্রপক্ষ/তদন্ত কর্মকর্তার মতামত
ক। আদালত রাষ্ট্রপক্ষ বা তদন্ত কর্মকর্তার মতামত জানতে চায়। তারা জামিনের বিরোধিতা করতে পারেন।
ধাপ ৫: আদালতের শুনানি ও সিদ্ধান্ত
ক। শুনানির পর আদালত বিচার-বিবেচনায় জামিন মঞ্জুর বা বাতিল করতে পারে।
খ। জামিন পেলে বন্ড (নির্ধারিত অর্থমূল্য ও জামিনদার) দিতে হয়।
গ। জামিন না পেলে পুনরায় তাকে জেলে পাঠানো হয়।
Production Case এ জামিন আবেদন পিটিশনের নমুনা :
বিষয়: জামিন আবেদন।
জনাব,
বিনীত নিবেদন এই যে, আসামি নাম………, GR No. 123/2025 মামলায় বর্তমানে অন্য মামলায় কারাবন্দি। আজ আদালতের Production Warrant-এর মাধ্যমে উপস্থাপন করা হয়েছে। উক্ত মামলায় তিনি নির্দোষ ও মিথ্যাভাবে জড়িত। অতএব, তাঁকে জামিনে মুক্তি দেওয়ার আবেদন জানাচ্ছি।
বিনীত,
[আইনজীবীর নাম ও স্বাক্ষর]
তারিখ:
বিস্তারিত আলোচনা (step by step)
কোন বিজ্ঞ আইনজীবি কোন প্রোডাকশন কেইসের কোন আসামীর জামিন করতে চাইলে তিনি প্রথমে একটি কাগজে আসামীর নাম, পিতার নাম ও ঠিকানা এবং কোন থানা হতে আসামীকে কোর্টে প্রেরণ করা হয়েছে তা লিখে কোর্ট হাজতখানার ওসিকে বিষয়টি বর্ণনা করলে তিনি থানার নাম অনুসারে/থানা ওয়াইজ আসামীর নাম ও তার পিতার নাম মিলিয়ে কেইস নম্বরটি জানিয়ে দিলে বিজ্ঞ আইনজীবি কেইস নম্বরটি লিখে নিবেন। তিনি কেইস নম্বরটিকে থানার নামের সাথে মিলিয়ে লিখবেন।
আবার ইচ্ছা করলে আইনজীবি ঐ সময় কোর্ট হাজতের ওসি সাহেবের অনুমতি নিয়ে কোর্ট হাজতে রাখা তার আসামীর সাথে দেখা করতে এবং মামলা সম্পর্কে আলাপ-আলোচনা করতে পারেন। অতঃপর বিজ্ঞ আইনজীবি সংশ্লিষ্ট জিআর সেকশন(থানার যেখানে ফৌজদারি মামলার FIR তথ্যসমূহ নথিভুক্ত, রক্ষণাবেক্ষণ ও আদালতে প্রেরণের কাজ পরিচালনা করা হয়) বা নন-জিআর সেকসনে (থানায় যেসব অভিযোগ-জিডি,মিসিং রির্পোট, ইউডি (UD) কেইস,বিতর্ক-মীমাংসা রিপোর্ট,নোটারি বা ভেরিফিকেশন সংক্রান্ত কাগজ ইত্যাদি থানায় নথিভুক্ত হয় কিন্তু তা আদালতে ফৌজদারি মামলা হিসেবে প্রেরিত হয় না) আসবেন। সেখানকার কর্মকর্তাদেরকে অনুরোধ করে তিনি তার মামলার এজাহার, ও ফরোয়ার্ডিং বাহির করে প্রয়োজনীয় নোট নিবেন। এফ আই আর বা এজাহার হতে মামলার এফ আই আর ফরম হইতে মামলার ধারা, বাদীর নাম, পিতার নাম, ঠিকানা, মামলার তারিখ ও সময়, মামলা রুজু করিবার সময়, ঘটনাস্থল ইত্যাদি লিখে নিবেন । অতঃপর এজাহার ও ফরোয়ার্ডিং এর খসড়া নকল সংগ্রহ করতে হবে। আসামীকে রিমান্ডে নেওয়ার প্রার্থনা করলে ফরোয়ার্ডিং এর বাম মার্জিনে ওসি এবং এসি মহোদয়ের সুপারিশ থাকে। কাজেই সেইগুলোও হুবহু নোট করে নিতে হবে। বিশেষভাবে স্মরণ রাখতে হবে যে সকল মামলার এফ আই আর ফরম এবং এজাহার প্রথমে থানা হতে কোর্ট হাজতে, অতঃপর কোর্ট হাজত হতে ডেসপাচ সেকসনে এবং পরে ডেসপাচ সেকসন হতে জিআর বা নন-জিআর সেকসনে পাঠানো হয়।তাছাড়া ফরোয়ার্ডিং ও অন্যান্য প্রতিবেদন থানা হতে প্রথমে কোর্ট হাজতে এবং পরে কোর্ট হাজত হতে এটিকে সরাসরি জিআর সেকসনে পাঠানো হয়। সাধারণত দেখা যায় যে, রিমাণ্ডের ক্ষেত্রে আইও-Investigating Officer (তদন্তকারী কর্মকর্তা) যত দিনের রিমাণ্ড চান ওসিOfficer-in-Charge(থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা) এর চাইতে কম সময় রিমাণ্ড চান এবং এসি Assistant Commissioner (সহকারী কমিশনার) ওসির চাইতে আরও কয়েক দিন কম চান। এমনও দেখা গিয়াছে যে রিমাণ্ড প্রেয়ারে এসি র কোন সুপারিশ নাই অর্থাৎ তিনি কোন রিমাণ্ড চান নাই। আবার এমনও দেখা গিয়াছে যে ওসি এবং এসি সমান সমান দিনের জন্য রিমাণ্ডের সুপারিশ করেছেন।
অতঃপর বিজ্ঞ আইনজীবি আসামীপক্ষের তদবিরকারকে মামলার বিবরণ জানাবেন এবং তার ফিসসহ জামিন করাতে এবং বেইলবন্ড দিতে সর্ব মোট কত টাকা খরচ পড়বে এর একটি আনুমানিক অংক আসামীর লোকজনকে জানাবেন। আসামীর লোকজন বিজ্ঞ আইনজীবির যাচনা মোতাবেক অর্থ খরচ করতে রাজী হলে আইনজীবি ঢাকা মেট্রোপলিটান বার এসোসিয়েশনের একটি কিংবা ঢাকা আইনজীবি সমিতির দুইটি ওকালতনামা [১০–১০০ টাকা (বা তার কম বেশি, নির্ভর করে)] ক্রয় করে এর নীচে আসামীর লোকের দস্তখত নিবেন। ওকালতনামার নীচে আসামীর লোকের এইরূপ দস্তখত নেওয়া খুবই প্রয়োজন। কারণ কোর্ট হাজতে বন্দী আসামী ওকালতনামাতে তার পরিচিত লোকের দস্তখত দেখে ওকালতনামাটি খুব আনন্দের সাথে সম্পাদন করে দিবে এবং মনঃস্তাত্বিকভাবেও এই ভেবে চাঙ্গা থাকবে যে তার আপন লোক তার জামিনের জন্য চেষ্টা করছে।
অতঃপর বিজ্ঞ আইনজীবি উক্ত ওকালতনামা পূরণ করে কোর্ট হাজতের সামনে কর্তব্যরত কোন কনষ্টেবলকে উক্ত ওকালতনামাটি দিয়ে - তাকে কোর্ট হাজতের ভিতর হতে উক্ত ওকালতনামায় আসামীর স্বাক্ষর আনার জন্য দায়িত্ব দিবেন। উক্ত কনষ্টেবল কোর্ট হাজতের ভিতরে প্রবেশ করে আসামীর নাম ডেকে আসামীকে খুঁজে বের করে আসামীর নাম, তার পিতার নাম ও ঠিকানা জিজ্ঞাসা করে আসামীর আইডিনটিটি সম্পর্কে নিশ্চত হয়ে ওকালতনামায় আসামীর স্বাক্ষর নিবেন। অতঃপর উক্ত কনষ্টেবল উক্ত ওকালতনামাটিকে কোর্ট হাজতের ওসির সম্মুখে পেশ করলে তিনি উক্ত ওকালতনামায় আসামীর দস্তখতের নীচে "সত্যায়িত” সিল দিয়ে তার ইনিশিয়াল ও তারিখ লিখে ওকালতনামার উল্টা পৃষ্ঠায় ঐ কনষ্টেবলের নাম লিখে ওকালতনামাটিকে ঐ কনষ্টেবলের নিকট ফেরত দিবেন। অতঃপর কনষ্টেবল ওকালতনামাটিকে বিজ্ঞ আইনজীবির কাছে নিকট ফেরত দিবেন। উপরোক্ত পদ্ধতিতে ওকালতনামায় আসামীর স্বাক্ষর নেওয়াকে আদালত প্রাঙ্গণের চালু ভাষায় পাওয়ার নেওয়া বলে।
আবার বিজ্ঞ আইনজীবি ইচ্ছা করলে ওসি, হাজতখানার অনুমতি নিয়ে কোর্ট হাজতে প্রবেশ করে নিজেই আসামীর নিকট হতে ওকালতনামায় স্বাক্ষর নিতে পারেন। আসামীর নিকট হতে উক্ত রূপে ওকালতনামায় আসামীর দস্তখত ্নিয়ে ওকালতনামাটিকে বিজ্ঞ আইনজীবি হাজতের ওসির সম্মুখে পেশ করলে ওসি উক্ত ওকালতনামায় আসামীর স্বাক্ষরের নীচে "সত্যায়িত" সিল দিয়ে তার ইনিশিয়াল দেন, তারিখ লিখেন এবং ওকালতনামার উল্টা পৃষ্ঠায় Self লিখে দেন। এইরূপ Self লিখার অর্থ হল বিজ্ঞ আইনজীবি স্বয়ং আসামীর নিকট হতে ওকালতনামায় আসামীর স্বাক্ষর সংগ্রহ করেছেন।
অতঃপর উক্ত আসামীর জন্য রিমাণ্ড প্রেয়ার থাকলে তা বাতিলপূর্বক অথবা রিমান্ডের আবেদন না থাকলে শুধু মাত্র জামিনের আবেদন লিখে দরখাস্তে নির্ধারিত কোর্ট ফিস লাগিয়ে দরখাস্তের নিচে ওকালতনামা সাজিয়ে পিন আপ করতে বা ষ্টেপলিং করতে বা সুতা দিয়া গাঁথিয়া নিতে হবে এবং সংশ্লিষ্ট জিআর এ জমা দিতে হবে। উক্ত প্রোডাকশন মামলাগুলো নির্ধারিত আদালতে কখন পেশ করা হবে তা জেনে জামিনের দরখাস্ত মুভ করার জন্য সংশ্লিষ্ট আদালতে অপেক্ষা করতে হবে এবং পেশকার/সি এস আই মামলার নম্বর ডাকা মাত্র জামিন মুভ করতে হবে। আদালত আসামীর জামিন মঞ্জুর করলে নির্ধারিত পদ্ধতিতে আসামীর জামিননামা প্রদান করতে হবে। ভুল হলে কিংবা কোন বিষয়য় বাদ পড়লে জানাবেন প্লিজ।Thanks...
0 Comments