মোডাস অপারেন্ডি: অপরাধ তদন্তে প্রয়োগ
মোডাস অপারেন্ডি (Modus Operandi) শব্দটির উৎপত্তি লাতিন ভাষা থেকে, যার অর্থ “কাজ করার ধরন” বা “পদ্ধতি”। অপরাধ তদন্তে এটি বোঝায় অপরাধী অপরাধ সংঘটনের সময় যে বিশেষ কৌশল, ধাপ, উপায় বা আচরণগত প্যাটার্ন অনুসরণ করে। প্রতিটি অপরাধীর নিজস্ব কিছু বৈশিষ্ট্য থাকে, যা তার মানসিক অবস্থা, পূর্ব অভিজ্ঞতা, দক্ষতা এবং পরিস্থিতি দ্বারা প্রভাবিত হয়। মোডাস অপারেন্ডি তদন্তকারীদের জন্য অপরাধের ধরণ, অপরাধীর প্রোফাইল, এবং সম্ভাব্য সন্দেহভাজন চিহ্নিতকরণের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ সূত্র হিসেবে কাজ করে। অপরাধী অপরাধ সংঘটনের সময় যেসব ধাপ নিয়মিতভাবে অনুসরণ করে, যেমন—সময় নির্বাচন, ভুক্তভোগী নির্বাচন, অস্ত্রের ধরন, অপরাধস্থলে প্রবেশ ও পালানোর উপায়—এসব মিলিয়ে গড়ে ওঠে তার “অপরাধের স্বাক্ষর” বা signature, যা মোডাস অপারেন্ডির অংশ।
অপরাধ বিজ্ঞানে মোডাস অপারেন্ডি শুধু অপরাধীর ধরা পড়ার সম্ভাবনা কমানো নয়, বরং অপরাধ সংঘটনের দক্ষতা বৃদ্ধি এবং ভুক্তভোগীর উপর প্রভাব নিয়ন্ত্রণেরও একটি মাধ্যম। উদাহরণস্বরূপ, একজন অভ্যাসগত চোর সবসময় ভোরের আগে ফাঁকা বাড়ি বেছে নেয় এবং তালা ভাঙতে একটি নির্দিষ্ট ধরনের কাটার ব্যবহার করে। একজন সিরিয়াল খুনী হয়তো একই পদ্ধতিতে ভুক্তভোগীকে অচেতন করে হত্যা করে এবং অপরাধস্থল থেকে প্রমাণ মুছে ফেলার জন্য নির্দিষ্ট ধরনের রাসায়নিক ব্যবহার করে। এসব পুনরাবৃত্তি করা অভ্যাসই তদন্তকারীদের কাছে মোডাস অপারেন্ডি হিসেবে চিহ্নিত হয় এবং তা অপরাধীর সনাক্তকরণে সহায়তা করে।
মোডাস অপারেন্ডি বিশ্লেষণের মূল উদ্দেশ্য হলো অপরাধীর আচরণগত ধারা নির্ধারণ এবং তা পূর্ববর্তী অপরাধের সাথে মিলিয়ে দেখা। ক্রিমিনোলজিস্টরা সাধারণত তিনটি মূল প্রশ্ন বিবেচনা করেন: (১) অপরাধী কীভাবে অপরাধটি সংঘটন করেছে? (২) কেন এই পদ্ধতি বেছে নিয়েছে? (৩) পূর্ববর্তী অপরাধগুলোর সাথে এর মিল কী? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খোঁজার মাধ্যমে তদন্তকারীরা অপরাধীর মানসিক প্রোফাইল তৈরি করতে পারেন, যা ভবিষ্যতে তাকে ধরতে সহায়ক হয়। অনেক সময় মোডাস অপারেন্ডি অপরাধীর ব্যক্তিগত জীবনের প্রতিফলন ঘটায়—যেমন তার পেশাগত দক্ষতা, বসবাসের এলাকা, বা সামাজিক অভ্যাস।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে, যদিও ফৌজদারি কার্যবিধি (Criminal Procedure Code) বা দণ্ডবিধি (Penal Code) তে “মোডাস অপারেন্ডি” শব্দটি সরাসরি নেই, তবুও তদন্তকারীরা অপরাধ বিশ্লেষণে এই ধারণাটি ব্যবহার করে থাকেন। উদাহরণস্বরূপ, মামলার তদন্ত প্রতিবেদনে প্রায়শই উল্লেখ করা হয়—“অভিযুক্ত পূর্ববর্তী অপরাধের মতোই একই পদ্ধতিতে অপরাধটি সংঘটন করেছে।” আদালতে এই তথ্য উপস্থাপন করলে বিচারক অভিযুক্তের ধারাবাহিক অপরাধপ্রবণতা সম্পর্কে ধারণা পান, যা শাস্তি নির্ধারণে প্রভাব ফেলতে পারে।
অপরাধ তদন্তে মোডাস অপারেন্ডি নির্ধারণের ধাপগুলো সাধারণত নিম্নরূপ—
১. অপরাধস্থল বিশ্লেষণ: অপরাধের ধরন, প্রমাণের ধরণ, এবং ঘটনাস্থলের পরিস্থিতি থেকে অপরাধ সংঘটনের ধাপ পুনর্গঠন।
২. পূর্ববর্তী মামলার সাথে তুলনা: অপরাধের পদ্ধতি, সময়, স্থান ও ভুক্তভোগীর ধরনে মিল বা অমিল নির্ধারণ।
৩. অপরাধীর প্রোফাইল তৈরি: আচরণগত বিশ্লেষণ, ফরেনসিক প্রমাণ, সাক্ষ্য এবং ডিজিটাল প্রমাণ ব্যবহার করে সম্ভাব্য অপরাধী চিহ্নিত করা।
এই বিশ্লেষণ পদ্ধতি বিশেষত সিরিয়াল অপরাধ, সাইবার ক্রাইম, আর্থিক জালিয়াতি, চোরাচালান ও সংঘবদ্ধ অপরাধে বেশি কার্যকর। উদাহরণস্বরূপ, বাংলাদেশে সাইবার অপরাধীদের মধ্যে অনেকেই একটি নির্দিষ্ট ধরনের ফিশিং মেইল ফরম্যাট ব্যবহার করে, যা সময়ের সাথে তদন্তকারীরা শনাক্ত করতে সক্ষম হন। একইভাবে, সংঘবদ্ধ ডাকাত দলের ক্ষেত্রে তাদের চলাফেরা, অস্ত্রের ধরণ, এবং পালানোর পথ একই রকম থাকে, যা মোডাস অপারেন্ডি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।
আন্তর্জাতিকভাবে এফবিআই (FBI), স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড, ইন্টারপোলসহ বিভিন্ন সংস্থা মোডাস অপারেন্ডি ডাটাবেস (MO Databases) ব্যবহার করে থাকে, যেখানে অপরাধের ধরন, পদ্ধতি, ও অপরাধীর অভ্যাস সংরক্ষণ করা হয়। বাংলাদেশ পুলিশও ধীরে ধীরে ডিজিটাল ডাটাবেসে অপরাধের প্যাটার্ন সংরক্ষণ করছে, যাতে ভবিষ্যৎ তদন্তে দ্রুত মিল পাওয়া যায়।
মোডাস অপারেন্ডি এবং “অপরাধীর স্বাক্ষর” (Criminal Signature) এক নয়—এটি বোঝা জরুরি। মোডাস অপারেন্ডি অপরাধ সংঘটনের পদ্ধতি নির্দেশ করে, যা সময় ও পরিস্থিতির সাথে পরিবর্তিত হতে পারে। অপরদিকে “অপরাধীর স্বাক্ষর” হলো অপরাধীর মানসিক চাহিদা পূরণের একটি বিশেষ উপায়, যা সাধারণত অপরিবর্তিত থাকে। উদাহরণস্বরূপ, একজন চোর হয়তো তালা কাটার ধরন পরিবর্তন করতে পারে (MO পরিবর্তিত), কিন্তু সে সবসময় ভুক্তভোগীর বালিশ উল্টে রাখে (Signature অপরিবর্তিত)।
মোডাস অপারেন্ডি বিশ্লেষণে ফরেনসিক সায়েন্স গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। যেমন—আঙুলের ছাপ, ডিএনএ, পাদচিহ্ন, অস্ত্রের ব্যবহার, হাতের লেখার ধরণ, সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণ ইত্যাদি। এসব প্রমাণ অপরাধীর অভ্যাস এবং পূর্বের অপরাধের সাথে সরাসরি সম্পর্ক স্থাপন করতে সহায়ক।
তবে মোডাস অপারেন্ডি ব্যবহার করে অপরাধী চিহ্নিত করার ক্ষেত্রে কিছু সীমাবদ্ধতাও রয়েছে। প্রথমত, অভিজ্ঞ অপরাধীরা সচেতনভাবে তাদের পদ্ধতি পরিবর্তন করতে পারে যাতে তদন্তকারীরা বিভ্রান্ত হয়। দ্বিতীয়ত, কিছু ক্ষেত্রে একাধিক অপরাধী একই ধরনের পদ্ধতি ব্যবহার করতে পারে, ফলে সঠিক অপরাধী নির্ধারণ কঠিন হয়ে যায়। তাই মোডাস অপারেন্ডি একা নয়, বরং অন্যান্য প্রমাণ ও সাক্ষ্যের সাথে মিলিয়ে দেখা উচিত।
সব মিলিয়ে, মোডাস অপারেন্ডি অপরাধ তদন্তে একটি শক্তিশালী হাতিয়ার, যা তদন্ত প্রক্রিয়াকে বৈজ্ঞানিক, পদ্ধতিগত ও দ্রুততর করে তোলে। বাংলাদেশে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো এটি আরও কার্যকরভাবে প্রয়োগের জন্য প্রশিক্ষণ, প্রযুক্তি ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতা বাড়াতে পারে। বিশেষ করে ডিজিটাল অপরাধ ও সাইবার অপরাধে অপরাধীর প্যাটার্ন দ্রুত শনাক্ত করতে এটি অপরিহার্য। বিচার ব্যবস্থায় মোডাস অপারেন্ডি বিশ্লেষণ শুধু অপরাধীর দোষ প্রমাণেই নয়, ভবিষ্যৎ অপরাধ প্রতিরোধেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
রেফারেন্স:
1. Turvey, B. E. (2011). Criminal Profiling: An Introduction to Behavioral Evidence Analysis. Elsevier Academic Press.
2. Hazelwood, R. R., & Warren, J. I. (2003). Linkage analysis: Modus operandi, ritual, and signature in serial sexual crime. Aggression and Violent Behavior, 8(6), 587–598.
3. Douglas, J., & Munn, C. (1992). Crime Classification Manual. Lexington Books.
4. বাংলাদেশ পুলিশ, অপরাধ তদন্ত ম্যানুয়াল (সাম্প্রতিক সংস্করণ)।
5. Interpol. (2020). Criminal Analysis Manual.
0 Comments