সর্বশেষ

6/recent/ticker-posts

আর্ট অব সাবমিশন(ART OF SUBMISSION)


ART OF SUBMISSION


 “আর্ট অব সাবমিশন”

ভূমিকা


আইনের দুনিয়ায় প্রতিটি বিতর্ক, প্রতিটি মামলার মূল কেন্দ্রবিন্দু হলো বিচারকের সামনে কীভাবে যুক্তি উপস্থাপন করা হয়। আদালতে বিচারকের সিদ্ধান্ত গড়ে ওঠে আইন, নজির, প্রমাণ এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ—আইনজীবীর সাবমিশনের ভিত্তিতে। সাবমিশন কেবল তথ্য বলার প্রক্রিয়া নয়; এটি হলো এক ধরনের শিল্প, যেখানে আইনজীবী আইনের ব্যাখ্যা, যুক্তি এবং বাস্তব ঘটনাকে এমনভাবে সাজান যাতে তা বিচারকের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়। তাই আর্ট অব সাবমিশন বলতে বোঝায় আদালতে নিজের অবস্থানকে দৃঢ়ভাবে এবং কার্যকরভাবে উপস্থাপন করার দক্ষতা। বাংলাদেশসহ কমন ল’ দেশগুলিতে নতুন আইনজীবীদের জন্য সাবমিশনের দক্ষতা অপরিহার্য। কারণ, এটি শুধু ক্লায়েন্টের পক্ষে রায় আনে না, বরং ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার ভিত্তিও গড়ে তোলে।


আইনে সাবমিশনের সংজ্ঞা ও অর্থ


“Submission” শব্দটি আইনগত পরিভাষায় বোঝায় আদালতের কাছে প্রস্তাবিত যুক্তি বা অনুরোধ। এটি মৌখিক বা লিখিত হতে পারে। সাবমিশনের মাধ্যমে আইনজীবী আদালতের কাছে জানান কেন তার ক্লায়েন্টের অবস্থান সঠিক, এবং কোন ভিত্তিতে বিচারক সেই অবস্থানকে সমর্থন করতে পারেন। উদাহরণস্বরূপ, একটি ফৌজদারি মামলায় আইনজীবী সাবমিশনে দেখাতে পারেন যে অভিযোগ প্রমাণের জন্য যথেষ্ট সাক্ষ্য নেই, তাই অভিযুক্তকে খালাস দেওয়া উচিত। আবার দেওয়ানি মামলায় সাবমিশনের মাধ্যমে প্রমাণ করা যায় যে আইনের নির্দিষ্ট ধারা বাদীর দাবি সমর্থন করে।


কমন ল’ সিস্টেমে সাবমিশনের উৎপত্তি


কমন ল’ ব্যবস্থায়, বিশেষ করে ইংল্যান্ডে, সাবমিশনের ঐতিহ্য দীর্ঘ। মধ্যযুগীয় কোর্টে আইনজীবীরা তাদের বক্তব্য লিখিত আকারে দিতেন, যা পরে মৌখিকভাবে বিচারকের সামনে পাঠ করা হতো। ধীরে ধীরে এটি এক ধরনের শিল্পে রূপ নেয়। ব্যারিস্টাররা শিখতে থাকেন কিভাবে সংক্ষিপ্ত, পরিষ্কার এবং প্রভাবশালী ভাষায় তাদের ক্লায়েন্টের পক্ষে দাঁড়ানো যায়। বিখ্যাত টর্ট কেসে ’’Donoghue v. Stevenson [1932] AC 562” উভয় পক্ষের সাবমিশন আদালতকে “duty of care”–এর নতুন ব্যাখ্যা দিতে সাহায্য করে, যা আজও বহুল উদ্ধৃত। আজকের দিনে বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থাও সেই কমন ল’ ধারা অনুসরণ করছে, যেখানে সাবমিশন আদালতের কার্যপ্রণালির অবিচ্ছেদ্য অংশ।


অ্যাডভারসারিয়াল সিস্টেমে সাবমিশনের গুরুত্ব


অ্যাডভারসারিয়াল সিস্টেমে(adversarial system) যেমন বাংলাদেশ, ভারত বা যুক্তরাজ্যে প্রচলিত—দুই পক্ষের আইনজীবীই তাদের যুক্তি আদালতে পেশ করেন। বিচারক নিরপেক্ষ থাকেন এবং সিদ্ধান্ত নেন কার যুক্তি বেশি শক্তিশালী। এখানে সাবমিশনই আসল অস্ত্র। ভালো সাবমিশন বিচারককে প্রভাবিত করতে পারে, এমনকি প্রমাণ দুর্বল হলেও। অপরদিকে দুর্বল সাবমিশন শক্তিশালী প্রমাণকেও যথেষ্ট গুরুত্ব দিতে ব্যর্থ হতে পারে। তাই এই সিস্টেমে সাবমিশনকে অনেক সময় “মামলার মেরুদণ্ড” বলা হয়। বাংলাদেশে ফৌজদারি মামলায় ডিফেন্স সাবমিশনের (Defence Submission) মাধ্যমে অনেক সময় দেখাতে পারে যে সাক্ষীর জবানবন্দি অসঙ্গতিপূর্ণ। ফলে আদালত যুক্তিসঙ্গত সন্দেহের কারণে অভিযুক্তকে খালাস দেন।


বাংলাদেশে সাবমিশনের ব্যবহারিক রূপ


বাংলাদেশের আদালতে সাবমিশন নানা রূপে দেখা যায়। হাইকোর্ট ডিভিশনে রিট আবেদন শোনানির সময় আইনজীবীরা লিখিত সাবমিশন দাখিল করেন। ফৌজদারি মামলায় অভিযুক্তের পক্ষে আইনজীবী মৌখিক সাবমিশনে দেখান অভিযোগের দুর্বল দিক। দেওয়ানি মামলায় সাবমিশন হয় প্রমাণ ও আইনগত ব্যাখ্যা মিলিয়ে। এখানে সাবমিশনের গুণগত মান অনেকাংশে নির্ভর করে আইনজীবীর প্রস্তুতি, গবেষণা এবং আদালতের ভাষাশৈলীর উপর। এখানে বলা যায়  Anwar Hossain Chowdhury v. Bangladesh (8th Amendment Case, 1989) মামলার কথা যেখানে মামলার উভয় পক্ষের সাবমিশন এতই শক্তিশালী ছিল যে বিচারপতিরা ১৩ দিনের শুনানিতে বিশাল লিখিত ও মৌখিক যুক্তি বিবেচনা করেন। ফলেই “basic structure doctrine” বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠিত হয়।


লিখিত সাবমিশন: বৈশিষ্ট্য ও কার্যকারিতা


লিখিত সাবমিশন হলো এক ধরনের বিস্তারিত নথি, যেখানে আইনের ধারা, নজির, প্রমাণ এবং যুক্তির সমন্বয় থাকে। এর সুবিধা হলো বিচারক পরবর্তী সময়ে নথিটি পড়তে পারেন এবং রায়ে উদ্ধৃত করতে পারেন। লিখিত সাবমিশনে শৃঙ্খলা, পরিস্কারতা এবং নির্ভুল উদ্ধৃতি অপরিহার্য। অনেক সময় বড় মামলায় আদালত শুধুমাত্র লিখিত সাবমিশনের উপর ভরসা করেন, বিশেষত যখন প্রমাণ জটিল এবং যুক্তি বহুমাত্রিক হয়। Bangladesh Italian Marble Works Ltd. v. Bangladesh (5th Amendment Case, 2010) মামলায় উভয় পক্ষের লিখিত সাবমিশন আদালতের রায়ে ব্যাপকভাবে উদ্ধৃত হয়।


মৌখিক সাবমিশন: কোর্টে উপস্থাপনার শিল্প


মৌখিক সাবমিশন সরাসরি আদালতে আইনজীবীর উপস্থাপন। এটি অনেক বেশি কৌশলনির্ভর। আইনজীবীকে বিচারকের প্রশ্নের উত্তর তাৎক্ষণিকভাবে দিতে হয়। এজন্য দরকার গভীর প্রস্তুতি এবং দ্রুত চিন্তার ক্ষমতা। অনেক বিচারক মৌখিক যুক্তির মাধ্যমে আইনজীবীর আত্মবিশ্বাস ও দক্ষতা মূল্যায়ন করেন। ইতিহাসে বহু বিখ্যাত কেস কেবল মৌখিক সাবমিশনের শক্তিতেই জিতেছে। Kesavananda Bharati v. State of Kerala (1973, India) মামলাটি ৬৮ দিনের শুনানি হয়েছিল, যেখানে মৌখিক সাবমিশন ছিল মূল আকর্ষণ। ভারতীয় সংবিধানের মৌলিক কাঠামো তত্ত্ব“basic structure doctrine” এখান থেকেই আসে।


ফ্যাক্টস, আইন ও নজির–এর সমন্বয়


একজন দক্ষ আইনজীবী জানেন কেবল আইন বা নজির যথেষ্ট নয়। সাবমিশনের সময় তিনি তিনটি উপাদানকে একত্র করেন—ঘটনার সত্য (facts), প্রযোজ্য আইন (law) ও পূর্ববর্তী রায় (precedent)। এই সমন্বয় ছাড়া সাবমিশন দুর্বল হয়ে পড়ে। যেমন, বাংলাদেশ সংবিধানের ৩২ অনুচ্ছেদ নিয়ে রিট করলে শুধু সংবিধান নয়, আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সনদ এবং দেশীয় কেস-ল’ও টেনে আনতে হয়। যদি কোনো মামলা চুক্তিভঙ্গ নিয়ে হয়, তবে সাবমিশনে চুক্তির শর্তাবলি (ফ্যাক্টস),চুক্তি আইন, ১৮৭২ এর ধারা (আইন) এবং পূর্ববর্তী কেস-ল’ যেমন Mohori Bibee v. Dharmodas Ghose (1903) (নজির) দেখাতে হবে।


বিচারকের সামনে সাবমিশনের কৌশল


কৌশল হলো সাবমিশনের প্রাণ। কবে কথা বলবেন, কবে নীরব থাকবেন, কোন বিষয় আগে তুলবেন—এসব নির্ধারণ করে সাবমিশনের শক্তি। অনেক সময় আইনজীবী ইচ্ছাকৃতভাবে দুর্বল দিক উপস্থাপন করেন না, বরং জোর দেন শক্তিশালী জায়গায়। আবার কখনো বিচারকের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন তোলা হয়।


প্রি-ট্রায়াল সাবমিশন বনাম ট্রায়াল সাবমিশন


প্রি-ট্রায়াল সাবমিশন সাধারণত আবেদন বা মোশন আকারে হয়, যেমন অভিযোগ গঠন বাতিলের আবেদন। ট্রায়াল সাবমিশন হলো মামলার মূল শুনানির সময় উপস্থাপন করা যুক্তি। দুই ক্ষেত্রেই কৌশল আলাদা। প্রি-ট্রায়ালে লক্ষ্য থাকে মামলাটিকে দুর্বল করে ফেলা বা বাতিল করা। ট্রায়ালে লক্ষ্য থাকে আদালতকে রায়ে প্রভাবিত করা।


আপিল কোর্টে সাবমিশনের আলাদা চরিত্র


আপিল কোর্টে সাবমিশন মূলত নিম্ন আদালতের ত্রুটি তুলে ধরার উপর নির্ভর করে। এখানে নতুন প্রমাণ নয়, বরং আইনগত প্রশ্নই মুখ্য। তাই আপিল কোর্টে সাবমিশনের ভাষা হয় অনেক বেশি আইনি, এবং নজির-ভিত্তিক।


বিখ্যাত কেস-ল’ যেখানে সাবমিশন সিদ্ধান্ত বদলেছে


ইতিহাসে অনেক কেস আছে যেখানে সাবমিশনের দক্ষতা মামলার গতিপথ বদলেছে। যেমন, ভারতের কেস Kesavananda Bharati v. State of Kerala–এ আইনজীবীদের অসাধারণ সাবমিশনের ফলেই “Basic Structure Doctrine” প্রতিষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশে 8th Amendment Case–এও আইনজীবীদের শক্তিশালী সাবমিশন বিচারকদের মত গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল।


নৈতিকতা, সততা ও সাবমিশন


সাবমিশন কখনোই মিথ্যা বা বিভ্রান্তিকর হওয়া উচিত নয়। আদালতের প্রতি আইনজীবীর প্রধান দায়িত্ব সততা। ভুল বা মিথ্যা তথ্য দিলে তা শুধু মামলার ক্ষতি করে না, আইনজীবীর সুনামও নষ্ট করে। তাই নৈতিকতার প্রশ্ন সাবমিশনের কেন্দ্রে থাকে।


আইনজীবীর ব্যক্তিত্ব, ভাষা ও কণ্ঠস্বরের প্রভাব


আইনজীবীর ভঙ্গি, কণ্ঠস্বর, চোখের দৃষ্টি পর্যন্ত সাবমিশনের অংশ। একজন আত্মবিশ্বাসী আইনজীবী বিচারকের উপর ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারেন। আবার জটিল বিষয়কে সহজ ভাষায় বলার ক্ষমতা সাবমিশনের শক্তি বহুগুণ বাড়ায়।


আদালতে সাবমিশনের মনস্তত্ত্ব


সাবমিশন শুধু আইন নয়, মনস্তত্ত্বও। বিচারক মানুষ, তাই তিনি প্রভাবিত হন ভাষা, যুক্তি, এমনকি আবেগে। একজন দক্ষ আইনজীবী জানেন কখন আবেগ ব্যবহার করতে হবে, কখন যুক্তির খেলা খেলতে হবে।


প্রযুক্তি ও ডিজিটাল সাবমিশন


ডিজিটাল যুগে সাবমিশন কেবল মৌখিক বা লিখিত নেই। এখন ভিডিও কনফারেন্স, ই-মেইল, অনলাইন ফাইলিংয়ের মাধ্যমে সাবমিশন দেওয়া হয়। প্রযুক্তি সাবমিশনকে আরও দ্রুত ও কার্যকর করেছে, তবে একই সাথে নতুন চ্যালেঞ্জও এনেছে।


বাংলাদেশে ই-ফাইলিং ও অনলাইন কোর্টে সাবমিশন


কোভিড-১৯–এর সময়ে বাংলাদেশে ভার্চুয়াল কোর্ট চালু হয়। আইনজীবীরা অনলাইনে সাবমিশন দেন। এতে দেখা যায়, ডিজিটাল কোর্টেও সাবমিশনের শিল্প সমান গুরুত্বপূর্ণ। কণ্ঠস্বর, ভিজ্যুয়াল প্রেজেন্টেশন, স্ক্রিনে ডকুমেন্ট দেখানো—সবই সাবমিশনের নতুন মাত্রা।


আন্তর্জাতিক দৃষ্টিভঙ্গি: ভারত, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র


ভারতে মৌখিক সাবমিশন দীর্ঘ হতে পারে, কখনো কখনো দিনকে দিন ধরে চলে। যুক্তরাজ্যে ব্যারিস্টাররা সংক্ষিপ্ত এবং প্রভাবশালী সাবমিশনের জন্য বিখ্যাত। যুক্তরাষ্ট্রে জুরি সিস্টেমের কারণে সাবমিশনে অনেক সময় সাধারণ মানুষের ভাষা ব্যবহার করা হয়।


সাবমিশনের ব্যর্থতা ও সফলতার কারণ


ভালো সাবমিশনের মূল হলো গবেষণা, প্রস্তুতি, এবং প্রেজেন্টেশনের দক্ষতা। ব্যর্থ সাবমিশনের কারণ সাধারণত গবেষণার অভাব, বিভ্রান্তি, অথবা বিচারকের মনোযোগ আকর্ষণে ব্যর্থতা। সফল সাবমিশন স্পষ্ট, যুক্তিনির্ভর এবং বাস্তবভিত্তিক হয়।


উপসংহার


আইনের জগতে সাবমিশন কেবল একটি টেকনিক নয়, এটি সত্যিই একটি শিল্প। যে আইনজীবী সাবমিশনের শিল্প আয়ত্ত করতে পারেন, তিনি আদালতে অর্ধেক যুদ্ধ জিতে যান। বাংলাদেশসহ কমন ল’ দেশগুলিতে আইনের ছাত্র এবং নতুন আইনজীবীদের জন্য সাবমিশনের দক্ষতা অর্জন অপরিহার্য। এটি আইনের প্রয়োগকে শক্তিশালী করে এবং ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার পথে সহায়ক হয়।


Post a Comment

0 Comments